বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩, ০৩:৪০ অপরাহ্ন
রহিমা আক্তার মৌ : গত বছর ৮ মার্চ সকাল বেলায় পত্রিকা হাতে পেয়ে থমকে গিয়েছিলাম। বছরটি গেছে খুবই আতঙ্ক আর হতাশার। পত্রিকা হাতে নিয়েই দেখেছি নারী দিবসে আমাদের অভিনন্দন জানানোর একটা ছবি। প্রশাসন ও দলীয় কোন্দলের কারণে বিএনপির নারী নেত্রীদের রাস্তায় ফেলে পেটানো ও টানা-হেঁচড়া করা। সেই ছবি দিয়ে স্বাগত জানানো হলো নারী দিবসকে। কবে থেকে নারী দিবস বা কেন নারী দিবস। এসব বিষয় আজ নয়। একজন নারী হয়ে কী পাচ্ছি নারী দিবসে, তাই নিয়ে ভাবনা। আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলো অনেক এগিয়ে এসেছে। অনেক উন্নত হচ্ছে। যে কোনো দিবসে, দিবসকে কেন্দ্র করে ক্রোড়পত্র ছাপানো হয়, কলাম-প্রবন্ধ লেখা হয়, পত্রিকার পাতায় পাতায় নারীর ছবি ও সংবাদ এটা নতুন কিছু নয়। তবে নারী দিবসকে কেন্দ্র করে নারী সংবাদ, আলোচনা-সমালোচনা, নারীর সাফল্য-ব্যর্থতা, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়। নারীর আলোচনা ও নারীর অধিকার নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো নাটক টেলিফিল্ম টকশোসহ অনেক অনুষ্ঠান প্রচার করে।
বর্তমানে টিভি চ্যানেলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হলো টকশো। একদম তরতাজা সংবাদ। তাজা তাজা ইস্যু নিয়ে চলে অনেক আলোচনা, টকশোর কথাবার্তা। অনেকে বলেন, সারা বছরের মাঝে এই এক দিন নারীর জন্য। আমি এর ঘোর বিরোধিতা করি। শুধু নারী দিবস নয়, যে কোনো দিবসেই এ বিষয় নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হয়। তাই বলে শুধু ৮ মার্চ নারীদের, বাকি ৩৬৪ দিন অন্য কারো তা বলা বা আলোচনা করা উচিত নয়, ভাবাটাও ঠিক নয়। আমরা তো ভুলিনি সেই কথাগুলো ‘পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ হলো নারী, আর অর্ধেক পুরুষ। অর্ধেক আকাশ ছাড়া বাকি অর্ধেকের যেমন মূল্য নেই বা দেখার কোনো উপায় নেই, তেমনি একটি দিন শুধু নারীর জন্য রেখে বাকিটা কেউ দাবি করা বা কাউকে দেয়ারও কোনো উপায় নেই।
২০১৪ সালের ৮ মার্চ পালিত হয়ে গেল ‘বিশ্ব নারী দিবস’। সন্ধ্যার পর টিভি চ্যানেলের সামনে বসি। প্রথমে থমকে উঠি সংবাদ দেখে। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হলেও একই ধরনের বিষয়। বিএনপির মহিলা সংগঠনের নেত্রীরা নারী দিবস উপলক্ষে তাদের কেন্দ্রীয় অফিস নয়াপল্টন থেকে শোভাযাত্রা বের করতে চায়, পুলিশ তাতে বাধা দেয়। পুলিশের সঙ্গে নারী সংসদ সদস্য ও নারী নেত্রীদের বাক-বিতন্ডা হয়। অবশেষে পুলিশের কড়া প্রহরার মাঝে নারীরা কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে সমাবেশ করে। দৃশ্যটা দেখে মনে হলো ১৮৫৭ সালের কথা। অবশ্য তখনকার যা জানা তা বইপত্র থেকেই জানা। নারীরা তাদের কাজের সময় ও পরিবেশের জন্য প্রথম আন্দোলন করে। নারীদের সেই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ নির্যাতন চালায়। নারীদের গ্রেফতারও করে। সেই থেকে নারী দিবসের সূচনা। অবশ্য নারী দিবস সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় ১৯১০ সালে আর জাতিসংঘ এই দিনটিকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালে।
প্রশ্ন হলো কেন এই নারী দিবসের দিন বিএনপির নেত্রীরা সমাবেশ বা শোভাযাত্রা করতে পারলেন না। পুলিশ বলছে, এই সমাবেশ বা শোভাযাত্রা বের করার কোনো অনুমতি তারা নেয়নি বা তাদের কাছে এই সমাবেশ করার অনুমতি পাওয়ার কোনো লিখিত কাগজ নেই। অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ তারা ৩ মার্চ অনুমতির জন্য গেলে সারা দিন বসিয়ে রেখে পরে বলা হয়, বিএনপির নেত্রীরা তাদের দায়িত্বেই সমাবেশ বা শোভাযাত্রা করবে। কিন্তু সর্বশেষ কথা হলো, বিএনপির নেত্রীদের তা করতে দেয়া হয়নি। বিএনপি সমর্থনকারীদের তা করতে দেয়া হয়নি। ১৮৫৭ সালে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল নিউইয়র্কে, সেই আন্দোলন আজও সেখানেই আছে। শুধু নিউইয়র্ক থেকে আন্দোলন পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৮৫৭ সালে যে নারীরা আন্দোলন করতে রাস্তায় নেমে আসেন, সেই নারীদের কোনো দল ছিল না। তাদের পরিচয় একটাই ছিল, তারা নারী। তারা সব নারীর জন্য আন্দোলন করছেন। তবে আজকের ২০১৩-১৪ সালের বাংলাদেশের নারীরা আন্দোলন করছেন, তবে নারী হয়ে নয় দলীয় নারী হয়ে, যার প্রমাণ পাই আমরা প্রশাসন ও ক্ষমতার ব্যবহারে।
বর্তমানে দেশের অবস্থা খারাপ নয় বলে মোটামুটি বলাটাই ভালো। এই সময়ে বিএনপির নেত্রীরা তাদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি পালন করলে ক্ষমতার বা প্রশাসনের কী ক্ষতি হতো। নারী হিসেবেই তো তারা কর্মসূচি পালন করতে চেয়েছিলেন। কর্মসূচির নামে হট্টগোল করার মতো নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল না। আর তেমন কিছু করলে পুলিশ তো ছিলই। নাকি কারও কারও সন্দেহ ছিল যে বিএনপির নেত্রীরা মিছিল বা শোভাযাত্রা বের করলে অন্য শোভাযাত্রার চেয়ে এখানে জনসংখ্যা বেশি হয়ে যেতে পারে, এজন্যই বের হতে দেয়া হয়নি তাদের। এখানে প্রশাসনের দোষ না দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারকেই দোষী ভাবা উচিত হবে। দেশের রাজনীতি রক্তাক্ত এবং ক্ষমতার এমন অবস্থা হয়েছে, ক্ষমতায় যে থাকে প্রশাসন তার কথায় উঠে, তার কথায় বসে। আজ থেকে ১০ বছর আগে বিটিভিকে প্রশ্ন করা হয়- বিটিভি তুমি কার? উত্তর আস্তে যখন যে ক্ষমতায় থাকে আমি তার। কিন্তু এখন সেই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নেই। প্রশাসন তুমি কার? যে ক্ষমতায় থাকে আমরা তার।
নারী দিবস নিয়ে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক স্থানে বিভিন্নভাবে দিবসটি পালন করা হয়েছে। দিবস পালনের বিভিন্ন দল যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতসব অনুষ্ঠান সমাবেশ শোভাযাত্রা- এত কিছুর মাঝে বিএনপির নেত্রীদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচিতে বাধা দেয়া কতটা সমালোচনার, তা এই দেশে বসে আর ভাবা যাবে না। কথায় কথায় বলে, এই দেশে নারীর রাজনৈতিক অবস্থান অনেক শক্ত। কিন্তু যে দেশে সরকার দলীয় নেত্রী নারী, স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, শুধু তাই নয়-প্রধান যে তিনটি দল আছে সবগুলোর নেত্রীই নারী। সেই দেশে নারী দিবসে দলীয় ব্যক্তি বলে কর্মসূচি পালন করতে পারবে না, এটা সম্পূর্ণই তামাশা, হাস্যকর আর ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়।
রাত ১০টায় টিভি চ্যানেলের টকশো দেখতে বসি। এটিএন নিউজ ও সময় টিভির খবরগুলো দেখি। সবাই নারী এবং নারী বিষয় নিয়ে কথা বলে। সময় টিভির অতিথি হিসেবে আসেন মেহতাব খানম ও সেলিনা হোসেন। দু’জনই আমার খুব প্রিয় ব্যক্তি। মেহতাব খানমের মুখেই শুনতে পারি প্রথম আলো পত্রিকার একটা নিউজের কথা। কথাটি হলো আইসিডিডিআরবি’র গবেষণায় উঠে আসছে দেশের গ্রামের ৮৯ ভাগ পুরুষ মনে করেন স্ত্রীকে মারার অধিকার পুরুষের আছে। আর শহরের ৮৩ ভাগ পুরুষ মনে করেন, স্ত্রীকে মারার অধিকার পুরুষের আছে। কথাটা শুনে অবাক হই না। তবে আক্ষেপ হয় এই ভেবে যে তাহলে আমিও কি …।
আলোচনায় অনেক দিক উঠে আসে। টেলিফোনে কথা হয় আমার। নারী দিবস ও পণ্যের সঙ্গে নারী হিসেবে বিলবোর্ড নিয়ে কিছু কথা বলি আর প্রশ্ন করি। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আমার সঙ্গে একমত হন এবং বিরোধিতা করে এর জন্য আইনি সহায়তা চায়। অবশ্য পুরনো আইনে কিছু হয় না। নতুন আইন হবে তারপর তার বাস্তবায়ন। তার পরও কিছুটা তো আলোচনায় এলো। পরদিন অর্থাৎ ৯ মার্চ কয়েকটি পত্রিকা হাতে নিই। ৮ তারিখের প্রথম আলো সংগ্রহ করি। পত্রিকার পাতায় পাতায় নারীর ছবি, নারীর সফলতা, নারীর ব্যর্থতা, নারীর কত কথা। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার ৩ সন্তানের মা এক মাস আগে নিখোঁজ হন। এক মাস পর জানা যায় সেই এক মাস আগে তাকে টিউবওয়েলের পাইপের গর্তের ভেতর মেরে ঢুকিয়ে রাখা হয়। মায়ের লাশের সেই স্থানে সন্তানদের আহাজারি। অবশ্য এক মাস পর এই মায়ের লাশকে লাশ বলব না কী বলব, তার ভাষা আমার জানা নেই। প্রত্যেকটা কাজে নারীর অবদান থাকছে, তবুও প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীরা ভুক্তভোগী হচ্ছে।
১৮৫৭ সালের আন্দোলন আর ২০১৪ সালের আন্দোলন- অনেক দিন পার হলো। আন্দোলনের ধরন পাল্টালো, স্লোগান পাল্টালো কিন্তু মূল ভাব একই রইল। সাফল্য অর্জনকারী নারীদের কথা যেমন শুনলে মন ভরে যায়, তাদের সাফল্যের পেছনের বাধা-বৈষম্যগুলো জানলে মনে হয় আসলে দিবস পালনের কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? কিছুদিন আগে টিভিতে দিবস পালনের এক উদ্যোক্তা বলছেন, আসলে দিবসগুলো সবাই ভুলে যায় আর সচেতন হওয়াটা তো অনেক দূরে। দিবসগুলো যেন ভুলে না যায় তার জন্যই দিবসগুলো পালন করা। চালিয়ে নেয়া। তবে লাভ তেমন কিছু হচ্ছে না।
আর নারী নির্যাতন! তার তো তেমন কোনো ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত নারী নির্যাতনের ঘটনার তথ্যের ভিত্তিতে এবছর ৪৭৭৭ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে গত এক বছরে উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ৪৯৪ জন। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে ২৪ জন। ৯৭৫ জন নারী বর্বর নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৮৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯৪ জনকে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৫৩ জনকে।
শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে ১৫৪ জন, এসিডদগ্ধের শিকার ৫০ জন, এসিডের কারণে মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। অগ্নিদগ্ধের শিকার ৫৩ জন। অগ্নিদগ্ধের কারণে মৃত্যু ২৭ জনের। অপহরণের শিকার হয়েছে মোট ১৩১ জন। নারী ও শিশু পাচার হয়েছে ২৭ জন, যাদের মধ্যে ১০ জনকে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার ৪৩৯ জন। যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ২৪৫ জন। ফতোয়ার শিকার হয়েছে ২৪ জন। এছাড়া ৮৯ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তার মধ্যে ২৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন কারণে ২৩৯ জনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হযেছে। ৩৮৬ নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। ১৭২ নারী ও শিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।
বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে ৬৭টি। পুলিশি নির্যাতনের শিকার ৩৭ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এই হিসাব দিয়েছে। জানি না এই হিসাবে আমার গ্রামের মোমেনা, তাহমিনা আর আমার এলাকার বিজলী, ইয়াসমিন ও পরিচিত লুবনা-তামান্নার নির্যাতনের হিসাব আসছে কিনা। না আসারই কথা। কারণ এই হিসাবগুলো বা ঘটনাগুলো প্রচারে আসা। মোমেনা, তাহমিনা, বিজলী, ইয়াসমিন, লুবনা, তামান্নার ঘটনাগুলো পাড়া-পড়শি ছাড়া তো আর কেউ জানে না। তাই তো হতাশায় দিন পার করছি সামনের নারী দিবসে আর কী কী পাওনা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
Leave a Reply