রেজাউল বলেন, “খরচ হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর দেড় টাকা কেজি দরে ১০০ বস্তা আলু বেচে ১২ হাজার ৬০০ টাকা পেয়েছি।” হিসাব কষে তিনি জানান, অবশিষ্ট আলু এ দামে বেচলে ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা লোকসান গুণতে হবে তাকে। পীরগাছা উপজেলার পারুল ইউনিয়নের দেউতি গ্রামের কৃষক মকবুল হোসেনের কাহিনিও একই।
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ২০ একর জমিতে কার্ডিনাল জাতের আলু চষেন তিনি। “২ টাকা কেজি দরে আলু বেচে পুঁজি হারিছি,” বললেন তিনি। আলুর এ করুণ চিত্র শুধু রংপুরে নয়। এ বিভাগের সব জেলাতেই একই অবস্থা।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার খোকারবাজার এলাকার আলু চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, “ধার দেনা করে ৭৫ হাজার টাকা খরচ করে পাঁচ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেছি। “কিন্তু বাজারে আলু বিক্রি করে দাম পেয়েছি মাত্র ৪০ হাজার টাকা।”দুশ্চিন্তা নিয়ে নজরুল প্রশ্ন করেন, “এখন বাকি ৩৫ হাজার টাকা আমি কোথায় পাব?” নজরুলের সঙ্গী মাহফুজার রহমানও আলু বুনেছেন। তার হিসাবে বিঘায় ১০ থেকে ১৩ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে তাদের।
তিনি দুঃখ করে বললেন, “দাম না পাওয়ায় কৃষকের হাতে টাকা নেই। তাই আলু তোলার ক্ষেত মজুরের হাতে টাকার বদলে আলু তুলে দিচ্ছেন তারা।
“ভাতের বিকল্প হিসেবে আলু সেদ্ধ খেয়ে দিন পার করছেন মজুররা। এ মাসের মাঝামাঝি ভাল দামের আশায় নজরুল ও মাহফুজার ২৫০ বস্তা আলু ট্রাকে করে খুলনায় বেচতে নিয়েছিলেন।
সেখানে টাকায় এক কেজি দর দেখে আলু রেখে পালিয়ে আসার কাহিনি পেড়ে আক্ষেপ করে মাহফুজার বললেন, “আসলে বাজারে আলুর থেকে দেখি বালুর দামই বেশি।”
এদিকে, মঙ্গলবার নীলফামারীর বড়বাজারে প্রতি কেজি গ্র্যানুলা আলু ১ থেকে ২ টাকা এবং কার্ডিনাল আলু ৪ থেকে ৫ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা যায়।
বস্তা প্রতি ৮৫-৯০ এবং ৩২০-৩৫০ টাকা পাইকাররা দর হাঁকছে। এ পরিস্থিতির কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, গতবারের আলু এখনও হিগারগার দখল করে আছে।
দাম ও ক্রেতা না থাকায় গত মৌসুমের আলু এখনো বিক্রি হয়নি বলে জানান রংপুরের শ্যামপুর হিমাগারের ব্যবস্থাপক আলী হায়দার। তিনি বলেন, “হিমাগারে জায়গা না থাকায় কর্তৃপক্ষ এ বছর আলু না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি মাইকিং করে কৃষকদের জানিয়েও দেয়া হচ্ছে।”
রংপুর অঞ্চলে ৪০টি হিমাগারে ১৫ লাখ মেট্রিক টন আলু রাখা যায়।
বাংলাদেশ হিমাগার এসোসিয়েশনের সদস্য ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, “এখন পর্যন্ত গত মৌসুমেরই ১০ লাখ মেট্রিক টন আলু মজুদ রয়েছে।
“দাম না থাকায় আলু নিচ্ছেন না চাষি ও ব্যবসায়ীরা। ফলে হিমাগার ভাড়া ও আগাম ঋণ বাবদ মালিকদের ২০ কোটি টাকা আটকে আছে।
তাই এবার আগাম ঋণ সুবিধা দিয়ে আলু রাখা হিমাগার মালিকদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অনেক হিমাগার মালিক আলু না রাখার ঘোষণা দিয়েছে।”
উত্তরবঙ্গে আলু চাষের হিসেবনিকেষ দিলেন কৃষি কর্মকর্তারা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক সেকেন্দার আলী বলেন, চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর ও গাইবান্ধায় ১ লাখ ৪০ হাজার একর জমিতে আলু চাষ করা হয়।
জমি তৈরি, বীজ, সার, সেচ, কীটনাশক ও আলু উত্তোলন পর্যন্ত একরে খরচ পড়েছে ৬০ হাজার টাকা। এ হিসাবে এক কেজি আলুর উৎপাদনে খরচ পড়েছে ৭ টাকা।
নীলফামারী কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক এসএম সিরাজুল ইসলাম জানান, তার জেলায় এবার ১৮ হাজার ৮৬৯ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। গতবারের চেয়ে প্রায় ২ হাজার হেক্টর বেশি ২১ হাজার ৯৮৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে এবার।
“লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার ৯৪৭ মে. টন আলু উঠবে এবার,” বলেন তিনি।
আলুর ফলন ভাল হলেও অবরোধ-হরতাল আর রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে সময়মতো বাজারজাত করতে না পারায় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নীলফামারীর সৈয়দপুরের সাজেদা হিমাগারের স্বত্তাধিকারী নোরেশা খাতুন বলেন, বাজার মূল্যের চেয়ে উৎপাদন, সংরক্ষণ খরচ বেশি হওয়ায় হিমাগারে রাখা আলুর দাবি কৃষকরা ছেড়ে দিয়েছে।
“এতে তারা যেমন অর্থ সঙ্কটে পড়েছে, তার চেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়তে হয়েছে আমাদের।” এই লোকসানের হাত থেকে বাঁচার আশায় সরকারে কাছে ঋণ মওকুফের দাবি জানানো হয়েছে বলে জানালেন তিনি।
এজেড এন বিডি ২৪/ রেজা
Leave a Reply