বৃহস্পতিবার, ১৮ অগাস্ট ২০২২, ১২:৩৯ পূর্বাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ২০২১ সালে রাশিয়ার সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বিরোধীদলীয় নেতা আলেক্সি নাভালনির কারাবাস। যাকে ২০২০ সালে বিষপ্রয়োগের হত্যাচেষ্টার অভিযোগ ওঠে ক্ষমতাসীন পুতিন সরকারের বিরুদ্ধে। চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি জার্মানি থেকে রাশিয়ায় ফিরলে বিমানবন্দরেই তাকে গ্রেফতার করে ক্রেমলিন পুলিশ। সেসময় সমর্থকদের উদ্দেশে বিক্ষোভের ডাক দেন তিনি। রাজধানী মস্কোসহ দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় পুতিনবিরোধী বিক্ষোভ। নাভালনির মুক্তির দাবিতে স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা। পাশাপাশি পুতিনের পদত্যাগের দাবিও জানান তারা। কিন্তু পুতিনের সরকার অটল। কঠোরভাবে দমন করেছে সেই আন্দোলন। কারাবন্দি হন নাভালনি।
ক্রেমলিনের সমালোচকদের কয়েক বছর ধরে দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগের মধ্য দিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার তিন দিনের পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, গণনা করা ভোটের মধ্যে পুতিনের দল ৫০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছে। ইউনাইটেড রাশিয়ার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট পার্টি পেয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ ভোট। ৪৫০ আসনের পার্লামেন্ট দুমায় এখন ইউনাইটেড রাশিয়ার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিদ্যমান। ফলে এর আগে প্রেসিডেন্ট পুতিন সংবিধান সংশোধনের বড় সুযোগ পান তাদের সমর্থন পেয়ে।
সংবিধানে সংশোধনী আনার ফলে পুতিনের ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর বাধা দূর হয় এবং ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার পথ পরিষ্কার হয় তার। এই নির্বাচনে দেখা গেলো যে পুতিনের শাসনের প্রতি সমর্থন হ্রাস তার বিজয়ের পথে কোনো বাধা নয়।
তথ্য বিশ্লেষক সের্গেই শপিলকিনের মতে, ফলাফল ঠিক করা না থাকলে, পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট পেতো।
অভিযোগ আছে, অ্যালেক্সি নাভালনিকে কারাবন্দি করা, তার সহযোগিদের দেশ থেকে তাড়ানো এবং তার সমর্থকদের ধরপাকড় চালিয়ে সমর্থন আদায় করেছে পুতিন সরকার। বলা হচ্ছে, ক্রেমলিন কার্যত অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। যার লক্ষ্য নির্বাচন উপায়ে পুতিনের বিকল্প থেকে মুক্তি পাওয়া।
ক্রেমলিনের পুতিন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এখন ইন্টারনেট। যা সুশীল সমাজকে সংগঠিত করতে সক্ষম এবং নাভালনিকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা স্বীকৃত নেতৃস্থানীয় বিরোধী রাজনীতিবিদ হিসেবে উন্নীত করেছে।
দেশটিতে ২০১৩ থেকে ১৫ সালের পর ২০২১ সাল পর্যন্ত ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার বেড়েছে ১৮ থেকে ৪৫ শতাংশ। তবে বিরোধীদলীয় নেতা নাভালনির জন্য রাষ্ট্রীয় চ্যানেল নিষিদ্ধ রয়েছে। যদিও তার ইউটিউব দর্শক যে কোনো রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের চেয়ে কম নয়।
ক্রেমলিন নাভালনিকে সমস্ত ওয়েবসাইট ব্যবহার করা থেকেও নিষিদ্ধ করেছে ‘চরমপন্থি’ হিসেবে চিহ্নিত করে। অ্যাপল এবং গুগলের অ্যাপ স্টোর থেকে নাভালনির তথ্য ও ছবি মুছে ফেলার জন্য রাশিয়ান স্টাফদের ওপর হুমকি দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মিডিয়া সংস্থা ও সাংবাদিকদের ‘বিদেশি এজেন্ট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, ফলে অনেকের রাশিয়ায় কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে ইউটিউব, গুগল ভিডিও হোস্টিং প্ল্যাটফর্মটি। প্রায়ই তারা অভিযোগ করছে, ক্রমাগত নাভালনির ফুটেজ সরানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করছে রাশিয়া। অথচ নাভালনির লাখ লাখ ভিউ রয়েছে এতে। ইউটিউবের জন্য এটি বন্ধ করা বড় সমস্যা। এই সার্ভিসটি নেয় রাশিয়ার লাখ লাখ মানুষ। যাদের রাজনীতি নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই বললেই চললে, কিন্তু এটি করলে তারা হয়তো মুখ ফিরিয়ে নেবে।
গুগলের ওপর এই চাপ ক্রমাগত বাড়াবে ক্রেমলিন। এমনকি জরিমানা করতে পারে, স্লো ডাউন করে দিতে পারে সার্চ ইঞ্জিন। এমনকি তারা নিজেদের ইউটিউব, ভিডিও-হোস্টিং প্ল্যাটফর্ম চালু করে জনপ্রিয় কনটেন্ট তৈরি করতে পারে। এরপর প্রয়োজন মতো বন্ধ করে দিতে পারে ইউটিউব।
সম্প্রতি রাশিয়ায় অবৈধ বলে বিবেচিত কনটেন্ট মুছতে বারবার ব্যর্থতার জন্য মস্কোর একটি আদালত গুগলকে ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন রুবল বা ৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা করে। তবে আদালতের প্রেস সার্ভিসের ঘোষণায় ওই আপত্তিকর কনটেন্ট সম্পর্কে বিশদ কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
গুগলকে জরিমানা করার পরপরই একই ইস্যুতে অর্থাৎ ব্যানড কনটেন্ট সরাতে ব্যর্থতার কারণে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফেসবুকের প্যারেন্ট কোম্পানি মেটাকে প্রায় ২৭ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেন রাশিয়ার আদালত। ফলে তথ্যের উপর একচেটিয়া অধিকার পুনরুদ্ধার করা পুতিনের ক্ষমতার কেন্দ্রকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। বলা বাহুল্য, ইন্টারনেট যুদ্ধ রাশিয়ার অদূর ভবিষ্যৎ সংজ্ঞায়িত করতে পারে।
রুশ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার দাপট এবার কাঁচি বসাচ্ছে অন্যান্য সংগঠনের ক্ষেত্রেও। সোভিয়েত যুগে যাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যারা কারাভোগ করেন অথবা যারা বিচারের মুখোমুখি হন তাদের স্মৃতি উদ্ধারে কাজ করে আসছে রাশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল মেমোরিয়াল সংগঠনটি। সম্প্রতি নাগরিকদের জন্য হুমকিস্বরূপ এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি বন্ধ করার নির্দেশ দেন মস্কোর সুপ্রিম কোর্ট।
এর আগে সংগঠনটিকে ‘ফরেন এজেন্ট’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। সংগঠনটি বন্ধ করার নির্দেশ আসার কারণ হিসেবে আদালতের কৌঁসুলি আলেক্সি জাফিয়ারভ বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের যে সুন্দর অতীত রয়েছে তা তুলে না ধরে সে সময়কার অপরাধগুলো তুলে ধরছে ইন্টারন্যাশনাল মেমোরিয়াল। আর এই কাজটি করা হচ্ছে পশ্চিমাদের স্বার্থে। বিদেশিদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের কারণে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে এই তকমা দেওয়া হয়। দেশটিতে ইন্টারন্যাশনাল মেমোরিয়াল প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৯ সালে।
সূত্র: দ্যা ইকোনমিস্ট, বিবিসি
এজেড এন বিডি ২৪/হাসান
Leave a Reply